পিয়ালের দেহখান, নিও না শ্মশান, এমনিতেও পুড়ে গেছে..

গত বছর এক কনসার্টে যাওয়ার পথে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ‘অড সিগনেচার’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আহাসান তানভীর পিয়ালের মৃত্যু হয়। এরপর অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যান্ডের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়। এক বছরের বেশি সময় পর সম্প্রতি এক কনসার্টে পারফর্ম করে প্রত্যাবর্তন হয়েছে অড সিগনেচারের। সেই সাথে স্বস্তি ফিরেছে ভক্তদের মনেও। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যখন দেহাবসান হয়, তখন আহাসান তানভীর পিয়ালের বয়স ছিল ২৬ বছর। আজ (১১ সেপ্টেম্বর) এই তরুণ সংগীতশিল্পীর জন্মদিন। মেঘ থেকে এই অঝোর ধারায় বর্ষণ তবে কি পিয়ালের তরে? তরুণ গায়ক ও গিটারিস্টের স্মৃতির প্রতি অর্পণ করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি। আল মাহফুজ-এর এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল গত বছর, পিয়ালের মৃত্যুর পরদিন। কিছুটা পরিমার্জন করে আজ তা তুলে ধরা হলো পাঠকের উদ্দেশে— ‘আমার দেহখান নিও না শ্মশানএমনিতেও পুড়ে গেছিআমার সব স্মৃতি ভুলো না তোমরাযা ফেলে গেছি..’ ২০২০ কি ২১। কোভিডকাল। নিয়মহীন নিহত দিন। মানুষ মরছে, শ্মশান পুড়ছে। লকডাউনে বাইরে যাওয়া হচ্ছে না, ঘরবন্দি সবাই। বন্ধুদের আড্ডা নেই। উভয় ঠোঁটের পরশ নেই। ধুলো পড়া ছাইদানির মতো বিবর্ণ সব। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না। সঞ্জীবদা’ শুনছিলাম, শুনছিলাম শেখ রানা। একমাত্র গানই তখন ধাতস্থ রাখছিল। নিজেও বেশ কিছু লিরিক লিখেছিলাম। একদিন সহসা কানে ভেসে এলো– ‘একা বসে তুমি দেখছো কি একই আকাশ?’ তাই তো। তখন সবাই যেন নিজ ঘরে খুব একা। প্রেমিক একা, প্রেমিকা একা। বন্ধুরা যার যার খোপে একা। বাবা একা, সন্তানেরও ধোপে টেকা না টেকার দ্বন্দ্ব। নির্ঘুম রাতে গানটা শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল– যেন শুয়ে আছি শবের শামিয়ানায়। ভয়াল শব্দের শহর এতো নিঃশব্দ! অন্ধকার আর মৃত মানুষের চিৎকার! ছায়া ও কায়ার মাঝে লড়াই। ঘোর লড়াই। ভাবনার রেলগাড়ি চলছিল– দিন শেষে কি আকাশের তারাগুলো উদ্ভাসিত হবে? সেই প্রথম ‘অড সিগনেচার’ শোনা। মনে হচ্ছিল, ভোকাল যেন নিগূঢ় নিশ্চল এক অনুভূতির সঙ্গে একাকার হয়ে গাচ্ছে। গানটাতে এতো ব্যথার সুর আর অভিমানের খেয়া পার! আহা.. মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ‘আমার দেহখান’-এর শিল্পী কি বেঁচে আছেন? মৃত্যু বিষয়ক এমন গান লিখে বা গেয়ে কারও কি পার্থিব জগতের আলো-বাতাস নেয়ার সাধ জাগবে? শেষমেশ জানা গেলো, বেঁচে আছেন দুই তরুণই– গীতিকার মুন্তাসির রাকিব ও ভোকাল আহাসান তানভীর পিয়াল। কেউ কেউ হয়তো মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা মাথায় আসা মাত্রই গান বাঁধতে পারেন। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা ভাবনার জগত থেকে এগিয়ে যায় আরও অনেক দূরে। জীবনে হয়তো এমন করাল সময় আসে যে, মরে যেতে ইচ্ছে হয়। অনাবিল আকাশ তখন অসহনীয়, দুঃসহ থমকে থাকা বাতাস। স্বজন বা বন্ধুরাও হয়ে যায় তখন দূরের মিনার। আবার কেউ কেউ আছেন, যারা এসবের মধ্য দিয়ে না গিয়েও শুধুমাত্র সৃজনশীলতা অথবা ইনটিউশন দিয়েই বানিয়ে ফেলতে পারেন এমন অনেক গান বা কবিতা! আদতে সৃজনশীলতার বৈশিষ্ট্যই এমন। যুগ যুগ ধরে চলছে এমনই। অড সিগনেচারের ‘আমার দেহখান’ গানটা প্রথম যখন শুনি, চট করে মনে পড়ে ‘পেপার রাইম’। নব্বই দশকের মাঝামাঝি যে ব্যান্ড আলোড়ন তুলেছিল দেশজুড়ে। মেলোডির সঙ্গে রকের মিশ্রণ ঘটিয়ে তারা বের করেছিল একটি অ্যালবাম। যেখানে ছিল বাংলা গানের ইতিহাস সৃষ্টি করা এক গান— ‘অন্ধকার ঘরে’। সে সময়ে এদেশের তরুণরা মেলানকোলিক মনে গুনগুন করে গাইতো– ‘নিকষ কালো এই আঁধারে, স্মৃতিরা সব খেলা করে, রয় শুধু নির্জনতা, নির্জনতায় আমি একা..’ এই দুইটা গান যদি কেউ শুনে থাকেন, তার বোঝার কথা– ‘অন্ধকার ঘরে’ থেকে ব্যাপক অনুপ্রাণিত ‘আমার দেহখান’ গানটা। কি লিরিকে, কি সুরে। উভয় গানের আবহ বা এনভায়রনমেন্টেও সাদৃশ্য রয়েছে। বুকের ভেতর থেকে হাহাশুন্য হাহাকার বেরিয়ে আসে শুনলে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনে হয়, সবকিছু ঠুনকো আর কৃত্রিম। মনে হয়, এই অবভাসের জগতে মিছেমিছি ঘুরছি। অথচ কি অবাক করা কাণ্ড! এই দুই গানের দুই ভোকালের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলো পরপর। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ এপ্রিল (২০২৪ সাল) মৃত্যুর কাছে হার মানলেন পেপার রাইমের ভোকাল আহমেদ সাদ। এর কয়েক দিনের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনার কবলে ধরাধাম ত্যাগ করলেন অড সিগনেচারের আহাসান তানভীর পিয়াল। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘অড সিগনেচার’। তারা যখন স্টেজে ওঠে, গান হয়ে যায় পায়রা। তখন তাদের আর গাইতে হয় না। পায়রা নিজেই গেয়ে ওঠে। আকাশ-বাতাস ধ্বনিত সর্বত্র ‘আমার দেহখান’। এই গান ভক্তদের ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও ফেরে। বোঝা যায় কনসার্টে, বোঝা যায় ভিডিওচিত্রে। বোঝা যায় দর্শকের কান্নায় অথবা আকুতির মিছিলে। পিয়ালের মৃত্যুর পর অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যান্ডের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে অড সিগনেচার। পিয়াল ছাড়া সাময়িক অচল গানের স্টেজ। দলের সঙ্গে পিয়ালকে না দেখে ভক্তদের কান্না হয়তো বাঁধ মানবে না। কান্নার রঙ ছুঁয়েও তারা হয়তো অড সিগনেচার শুনবে। তারা শুনবে নতুন কোনো গান অথবা ঘুমের প্রস্তাব। কিন্তু মেঘে ঢাকা তারার আলো ফুটবে যখন, পিয়ালকেই খোঁজা হবে। অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানো কোনো গল্পকার প্রার্থিত গল্প খুঁজে পেলে পিয়ালকেও খুঁজবে হয়তো। কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিয়ালদের খুঁজে পাওয়া যায় না। শিল্পীকে একদিন মরে যেতে হয় বলেই তার গান বেঁচে থাকে অজস্র জীবিতের হৃদয়ে?