Dhaka ০২:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News :
Logo ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন: আটক-১ Logo ফরিদপুরে আদম ব্যবসায়ীর ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন। Logo খুলনা জেলা ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাদিউজ্জামান হাদির জানাযায় আজিজুল বারী হেলাল। Logo মানিকগঞ্জে চরে বিএনপি’র ঐক্য ও শান্তি সমাবেশ Logo বিষ খাইয়ে প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানকে মা-বাবা হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার Logo চল্লিশ বছর পর বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে ফিরলো নিপালী নাগরিক Logo চাঁদপুরের কচুয়ায় আগুনে পুড়ল ২০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান Logo কেরুজ চিনিকলে চাকরি স্থায়ীকরণে অনিয়মের অভিযোগ : কেরুর এমডি’কে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ সদর দপ্তরের: অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা Logo পাবনার ভাঁড়ারার চেয়ারম্যান সুলতান গ্রেফতার Logo চাটমোহরে উদ্যোক্তাদের তৈরিকৃত স্বাস্থ্যসম্মত সরিষার তেল বিক্রয় প্রসারে বাজার সংযোগ সভা

আদার ব্যাপারির ডলারের খবর নেওয়ার কারণসমূহ

ডেস্ক এডিটর
  • Update Time : ০৩:১৯:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০২২
  • / ৪৪৩৫ Time View

একটা সময় ছিল যখন আদার ব্যাপারিরা জাহাজের খবর নিতেন না। তার দরকারও হতো না। আদার ব্যাপারিরা ছিলেন স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী। তাদের জাহাজের খবর নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। জাহাজ ছিল বড় বড় ব্যবসায়ীর কারবার। তাইতো ব্যঙ্গ করে বলা হয়, আদার ব্যাপারির আবার জাহাজের খবর!

আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে ব্যঙ্গ করার দিন এখন শেষ। এখন আর সেই বাস্তবতা নেই। সময় মানুষকে অনেক বদলে দিয়েছে। আজকাল শুধু আদার ব্যাপারীই নয়, সকল ব্যাপারীকেই জাহাজের খবর রাখতে হয়। আদার ব্যাপারীকেও রাখতে হয়। কেননা এখন আদা রপ্তানি বা আমদানি করতেও জাহাজ লাগে। শুধু আদার ব্যাপারীই নয়, রসুন ও পেঁয়াজ, সবজির ব্যাপারীকেও জাহাজের খবর নিতে হয়। আর একটু এগোলে দেখা যাবে ব্যাপারীদের এখন জাহাজের খবরই নিলেই চলে না, উড়োজাহাজের খবরও রাখতে হয়।

আদার ব্যাপারির প্রসঙ্গটি মনে এলো ডলারের মূল্যমান বাড়ার সুবাদে। অনেকে বলতে পারেন, আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই। টাকা নিয়ে আমাদের কায়কারবার। আমাদের হাতে ডাল-ভাত-নুন-তেল কেনার টাকা থাকলেই আমরা বর্তে যাই। ডলারের হিসাব রাখার আমাদের সময় কোথায়?

চিররঞ্জন সরকার:: কিন্তু না, এখন সময় বদলেছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, ঠিক তেমনি এখন একটা টানলে আরেকটা আসে। ইউক্রেইনে যুদ্ধ হলে আমাদের দেশে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ডলার সংকট হলে আমাদের অর্থনীতি দিশাহীন হয়ে পড়ে। কাজেই আমাদের ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে যেমন মাথা ঘামাতে হয়, একইসঙ্গে ডলারের দাম নিয়েও উদ্বিগ্ন হতে হয়। কারণ ডলারের দামের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।

টাকার এক্সচেঞ্জ রেট বা বিনিময় মূল্যের পতন অব্যাহত। এক ডলারের দাম শতক হাঁকিয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত দাম ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও বাস্তবে ৯৫ টাকার ওপরে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম যে ভাবে স্থির হয়, সেই চাহিদা আর জোগানের অঙ্ক মেনেই বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে টাকার দাম (বা টাকার সাপেক্ষে বিদেশি মুদ্রার দাম) নির্ধারিত হয়। বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে। বিদেশ থেকে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে হলে টাকায় সেই দাম মেটানো যায় না, তার জন্য সেই দেশের মুদ্রা (অথবা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার) প্রয়োজন হয়। আবার, বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনও দেশ কোনও পণ্য বা পরিষেবা কিনলে সেই মূল্য চুকাতে হয় টাকায়। অর্থাৎ, এই লেনদেনের জন্য বিদেশি মুদ্রা কেনা-বেচা চলে। পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশের পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটানোর জন্য বাজারে যত টাকার চাহিদা, তার তুলনায় বিদেশি পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটাতে বাংলাদেশে ডলারের চাহিদা বেশি, তা হলে স্বভাবতই ডলারের দাম বাড়বে, অর্থাৎ টাকার দাম কমবে। তা হলে, ডলারের অঙ্কে যে সব পণ্য ও পরিষেবা কিনতে হয়— অর্থাৎ, বিদেশ থেকে আমাদের দেশ যা আমদানি করে— তার খরচ বাড়বে। অন্য দিকে, সুবিধা হবে দেশের রপ্তানিকারকদের— টাকার অঙ্কে তাদের পণ্য বা পরিষেবার দাম অপরিবর্তিত থাকলেও ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমবে। স্মরণে রাখা জরুরি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক খানিকটা হলেও টাকার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে— ডলারের দাম বাড়লে নিজস্ব তহবিল থেকে বাজারে ডলার বিক্রি করে; দাম কমলে বাজার থেকে ডলার কিনে।

এই মুহূর্তে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের পতনের বহুবিধ কারণ থাকলেও প্রধান কারণ দুটি। এক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম থেকে রকমারি পণ্য, সব কিছুরই দাম বেড়েছে। অর্থাৎ, ডলারের অঙ্কে সেই পণ্যগুলির দাম বেড়েছে। বহু ক্ষেত্রেই আমদানির পরিমাণ যেহেতু অন্তত স্বল্পমেয়াদে কমানো অসম্ভব, ফলে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেরই। তাতে ডলার মহার্ঘ্য হয়েছে, উল্টো দিকে টাকার দাম পড়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক ক্ষেত্রে তুমুল অনিশ্চয়তা চলছে— এই অবস্থায় লগ্নিকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। সুদের হার বাড়ায় আমেরিকান ডলারে সে দেশে টাকা জমা রাখা লাভজনক, নিরাপদও। ফলে, বাংলাদেশের মতো বাজার থেকে লগ্নি তুলে নেওয়ার ঢল পড়েছে। গোটা এশিয়াতেই স্থানীয় মুদ্রা দুর্বল হয়েছে এখন— চিনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন, সবেরই পতন ঘটছে। ভারতীয় রুপিও ব্যতিক্রম হয়নি।

টাকার বিনিময় মূল্য কমার প্রভাব সরাসরি পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়া মানেই এক দিকে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্য দিকে পণ্য পরিবহণের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়াও বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়— তার কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলিরও দাম বাড়ে। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয়, আবশ্যিক পণ্যের দাম তুমুল হারে বাড়ছে— সরকারিভাবে যতই তা সাড়ে পাঁচের নিচে দেখানো হোক, বাস্তবে পাইকারি মূল্যসূচকের বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে বলেই অর্থনীতিবিদদের অনুমান। টাকার দাম কমায় সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলেই আশঙ্কা। অন্য দিকে, এমন কিছু পণ্যও রয়েছে, যেখানে আমদানি খাতে বর্ধিত খরচ তৎক্ষণাৎ দাম বাড়িয়ে ক্রেতার কাছে চালান করা যায় না। এই স্ট্যাগফ্লেশনের পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য বাড়ালে বিক্রি কমার আশঙ্কাও যথেষ্ট।

ব্যাংকিং চ্যানেলেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এতে চাপে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমদানিকারকেরা। যেসব ব্যবসায়ীর রপ্তানি আয় নেই, কিন্তু আমদানি করতে হয়, তারা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন।

কারণ, আমদানির জন্য ব্যাংকে ডলার পাচ্ছেন না, পেলেও প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। কোনো কোনো গ্রাহককে ৯৭ টাকাও দিতে হচ্ছে। অপর দিকে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন বড় রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। কারণ, রপ্তানি বিল নগদায়নে তারা ভালো দাম হাঁকাচ্ছেন। প্রবাসীদের পরিবারও আগের চেয়ে বেশি আয় পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের মতো স্বস্তি ও অস্বস্তি আছে ব্যাংকগুলোয়ও। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি, তারা স্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে কয়েকটি বড় ব্যাংক। আর যাদের আমদানি খরচ বেশি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম, সেই সব ছোট ও নতুন ব্যাংকগুলো অস্বস্তিতে আছে।

ডলারের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে, ব্যাংকগুলো কত দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করতে পারবে, তা বেঁধে দিচ্ছে। একইভাবে আমদানি বিলের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তবে কোনো ব্যাংক এই দামে ডলার লেনদেন করতে পারছে না।

দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তা মিটছে না। এর ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া বাড়ার কারণে। ডলার–সংকট মোকাবিলায় বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করেছে সরকার। তারপরও ডলারের সংকট সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভও কমছে। রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে। আর ডলারের বিনিময় মূল্য ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। দাম বাড়ার আশায় অনেকে এখন ডলার মজুত করছে। বেশি দাম দিয়েও বাজারে খুব বেশি ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দাম বাড়তে থাকায় সবাই ডলার ধরে রাখছেন।

ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া এবং বাজারে বেচা-কেনাসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের টোটকা পরিস্থিতি সামাল দিতে কতটুকু কী ভূমিকা রাখবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য আপাতত গভীর উদ্বেগের কারণ।

Tag :

অগ্রযাত্রা স্যাটেলাইট টেলিভিশন (এটিভি বাংলা) লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ২ নং শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ স্বরণী, রমনা, ঢাকা-১২১৭।
মোবাইল: ০১৬৪৬৪৪৪৫৩০

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আদার ব্যাপারির ডলারের খবর নেওয়ার কারণসমূহ

Update Time : ০৩:১৯:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০২২

একটা সময় ছিল যখন আদার ব্যাপারিরা জাহাজের খবর নিতেন না। তার দরকারও হতো না। আদার ব্যাপারিরা ছিলেন স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী। তাদের জাহাজের খবর নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। জাহাজ ছিল বড় বড় ব্যবসায়ীর কারবার। তাইতো ব্যঙ্গ করে বলা হয়, আদার ব্যাপারির আবার জাহাজের খবর!

আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে ব্যঙ্গ করার দিন এখন শেষ। এখন আর সেই বাস্তবতা নেই। সময় মানুষকে অনেক বদলে দিয়েছে। আজকাল শুধু আদার ব্যাপারীই নয়, সকল ব্যাপারীকেই জাহাজের খবর রাখতে হয়। আদার ব্যাপারীকেও রাখতে হয়। কেননা এখন আদা রপ্তানি বা আমদানি করতেও জাহাজ লাগে। শুধু আদার ব্যাপারীই নয়, রসুন ও পেঁয়াজ, সবজির ব্যাপারীকেও জাহাজের খবর নিতে হয়। আর একটু এগোলে দেখা যাবে ব্যাপারীদের এখন জাহাজের খবরই নিলেই চলে না, উড়োজাহাজের খবরও রাখতে হয়।

আদার ব্যাপারির প্রসঙ্গটি মনে এলো ডলারের মূল্যমান বাড়ার সুবাদে। অনেকে বলতে পারেন, আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই। টাকা নিয়ে আমাদের কায়কারবার। আমাদের হাতে ডাল-ভাত-নুন-তেল কেনার টাকা থাকলেই আমরা বর্তে যাই। ডলারের হিসাব রাখার আমাদের সময় কোথায়?

চিররঞ্জন সরকার:: কিন্তু না, এখন সময় বদলেছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, ঠিক তেমনি এখন একটা টানলে আরেকটা আসে। ইউক্রেইনে যুদ্ধ হলে আমাদের দেশে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ডলার সংকট হলে আমাদের অর্থনীতি দিশাহীন হয়ে পড়ে। কাজেই আমাদের ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে যেমন মাথা ঘামাতে হয়, একইসঙ্গে ডলারের দাম নিয়েও উদ্বিগ্ন হতে হয়। কারণ ডলারের দামের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।

টাকার এক্সচেঞ্জ রেট বা বিনিময় মূল্যের পতন অব্যাহত। এক ডলারের দাম শতক হাঁকিয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত দাম ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও বাস্তবে ৯৫ টাকার ওপরে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম যে ভাবে স্থির হয়, সেই চাহিদা আর জোগানের অঙ্ক মেনেই বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে টাকার দাম (বা টাকার সাপেক্ষে বিদেশি মুদ্রার দাম) নির্ধারিত হয়। বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে। বিদেশ থেকে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে হলে টাকায় সেই দাম মেটানো যায় না, তার জন্য সেই দেশের মুদ্রা (অথবা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার) প্রয়োজন হয়। আবার, বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনও দেশ কোনও পণ্য বা পরিষেবা কিনলে সেই মূল্য চুকাতে হয় টাকায়। অর্থাৎ, এই লেনদেনের জন্য বিদেশি মুদ্রা কেনা-বেচা চলে। পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশের পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটানোর জন্য বাজারে যত টাকার চাহিদা, তার তুলনায় বিদেশি পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটাতে বাংলাদেশে ডলারের চাহিদা বেশি, তা হলে স্বভাবতই ডলারের দাম বাড়বে, অর্থাৎ টাকার দাম কমবে। তা হলে, ডলারের অঙ্কে যে সব পণ্য ও পরিষেবা কিনতে হয়— অর্থাৎ, বিদেশ থেকে আমাদের দেশ যা আমদানি করে— তার খরচ বাড়বে। অন্য দিকে, সুবিধা হবে দেশের রপ্তানিকারকদের— টাকার অঙ্কে তাদের পণ্য বা পরিষেবার দাম অপরিবর্তিত থাকলেও ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমবে। স্মরণে রাখা জরুরি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক খানিকটা হলেও টাকার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে— ডলারের দাম বাড়লে নিজস্ব তহবিল থেকে বাজারে ডলার বিক্রি করে; দাম কমলে বাজার থেকে ডলার কিনে।

এই মুহূর্তে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের পতনের বহুবিধ কারণ থাকলেও প্রধান কারণ দুটি। এক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম থেকে রকমারি পণ্য, সব কিছুরই দাম বেড়েছে। অর্থাৎ, ডলারের অঙ্কে সেই পণ্যগুলির দাম বেড়েছে। বহু ক্ষেত্রেই আমদানির পরিমাণ যেহেতু অন্তত স্বল্পমেয়াদে কমানো অসম্ভব, ফলে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেরই। তাতে ডলার মহার্ঘ্য হয়েছে, উল্টো দিকে টাকার দাম পড়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক ক্ষেত্রে তুমুল অনিশ্চয়তা চলছে— এই অবস্থায় লগ্নিকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। সুদের হার বাড়ায় আমেরিকান ডলারে সে দেশে টাকা জমা রাখা লাভজনক, নিরাপদও। ফলে, বাংলাদেশের মতো বাজার থেকে লগ্নি তুলে নেওয়ার ঢল পড়েছে। গোটা এশিয়াতেই স্থানীয় মুদ্রা দুর্বল হয়েছে এখন— চিনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন, সবেরই পতন ঘটছে। ভারতীয় রুপিও ব্যতিক্রম হয়নি।

টাকার বিনিময় মূল্য কমার প্রভাব সরাসরি পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়া মানেই এক দিকে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্য দিকে পণ্য পরিবহণের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়াও বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়— তার কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্বর্তী পণ্য। সেগুলিরও দাম বাড়ে। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয়, আবশ্যিক পণ্যের দাম তুমুল হারে বাড়ছে— সরকারিভাবে যতই তা সাড়ে পাঁচের নিচে দেখানো হোক, বাস্তবে পাইকারি মূল্যসূচকের বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে বলেই অর্থনীতিবিদদের অনুমান। টাকার দাম কমায় সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলেই আশঙ্কা। অন্য দিকে, এমন কিছু পণ্যও রয়েছে, যেখানে আমদানি খাতে বর্ধিত খরচ তৎক্ষণাৎ দাম বাড়িয়ে ক্রেতার কাছে চালান করা যায় না। এই স্ট্যাগফ্লেশনের পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য বাড়ালে বিক্রি কমার আশঙ্কাও যথেষ্ট।

ব্যাংকিং চ্যানেলেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এতে চাপে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমদানিকারকেরা। যেসব ব্যবসায়ীর রপ্তানি আয় নেই, কিন্তু আমদানি করতে হয়, তারা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছেন।

কারণ, আমদানির জন্য ব্যাংকে ডলার পাচ্ছেন না, পেলেও প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। কোনো কোনো গ্রাহককে ৯৭ টাকাও দিতে হচ্ছে। অপর দিকে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন বড় রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। কারণ, রপ্তানি বিল নগদায়নে তারা ভালো দাম হাঁকাচ্ছেন। প্রবাসীদের পরিবারও আগের চেয়ে বেশি আয় পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের মতো স্বস্তি ও অস্বস্তি আছে ব্যাংকগুলোয়ও। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি, তারা স্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে কয়েকটি বড় ব্যাংক। আর যাদের আমদানি খরচ বেশি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম, সেই সব ছোট ও নতুন ব্যাংকগুলো অস্বস্তিতে আছে।

ডলারের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে, ব্যাংকগুলো কত দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করতে পারবে, তা বেঁধে দিচ্ছে। একইভাবে আমদানি বিলের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তবে কোনো ব্যাংক এই দামে ডলার লেনদেন করতে পারছে না।

দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তা মিটছে না। এর ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া বাড়ার কারণে। ডলার–সংকট মোকাবিলায় বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করেছে সরকার। তারপরও ডলারের সংকট সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভও কমছে। রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে। আর ডলারের বিনিময় মূল্য ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। দাম বাড়ার আশায় অনেকে এখন ডলার মজুত করছে। বেশি দাম দিয়েও বাজারে খুব বেশি ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, দাম বাড়তে থাকায় সবাই ডলার ধরে রাখছেন।

ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া এবং বাজারে বেচা-কেনাসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের টোটকা পরিস্থিতি সামাল দিতে কতটুকু কী ভূমিকা রাখবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য আপাতত গভীর উদ্বেগের কারণ।